https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

সুতার জাদুকরী বুনন: জামদানি – আমাদের ঐতিহ্য, ইউনেস্কোর গর্ব এবং এক কালজয়ী শিল্পের গল্প

top-news
  • 03 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

ঐতিহ্যের স্পর্শে আবেগের বুনন

বাঙালির কোনো উৎসব, বিয়ে বা বিশেষ দিন—সেখানে নারীর পরনে ঢাকাই জামদানি থাকবে না, এটা যেন ভাবাই যায় না। আলমারির ভাঁজ খুলে যখন একটি জামদানি শাড়ি বের করা হয়, তখন কেবল একটি শাড়ি বের হয় না; বেরিয়ে আসে হাজার বছরের ঐতিহ্য, শীতলক্ষ্যা নদীর আর্দ্র বাতাস আর তাঁতির ঘামের গন্ধ। জামদানি—নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সূক্ষ্ম কারুকাজ আর আভিজাত্যের এক অনন্য মিশেল। এটি কেবল সুতো দিয়ে বোনা কাপড় নয়, এটি বাংলার তাঁতিদের আঙুলের জাদুতে বোনা এক টুকরো কবিতা। ২০১৩ সালে ইউনেস্কো যখন জামদানিকে ‘মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন তা কেবল এই শিল্পের জয় ছিল না, ছিল সমগ্র বাংলাদেশের গৌরব। কিন্তু এই গৌরবের পেছনের গল্পটা কি আমরা সবাই জানি? আসুন, আজ ডুব দেই সেই সুতোর ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মহাকাব্যে।

জামদানির জন্মকথা: ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে

জামদানির ইতিহাস আর মসলিনের ইতিহাস একই সুতোয় গাঁথা। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘জামদানি’ শব্দটি এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে। ‘জাম’ অর্থ ফুল এবং ‘দানি’ অর্থ ধারণকারী বা পাত্র। অর্থাৎ, যে বস্তুতে ফুলের নকশা ধারণ করা হয়। আবার অনেকের মতে, ‘জাম’ অর্থ একধরণের উৎকৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’ মানে পেয়ালা—জামদানির নকশার জ্যামিতিক সৌন্দর্য বোঝাতে এই রূপক ব্যবহার করা হতো।

মোগল আমল ছিল জামদানির স্বর্ণযুগ। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্প উৎকর্ষের চরম শিখরে পৌঁছায়। তখনকার দিনে ঢাকাই মসলিনের ওপর যখন হাতে নকশা তোলা হতো, তাকেই বলা হতো জামদানি। সেই সময় একে বলা হতো ‘নকশি মসলিন’। ইতিহাস বলে, মোগল হেরেমের রাণীরা এবং রাজবংশের নারীরা এতটাই সূক্ষ্ম জামদানি ব্যবহার করতেন যা একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে গলে যেত। ইংরেজ শাসনামলে এই শিল্পের ওপর চরম আঘাত আসে, তবুও বাংলার তাঁতিরা তাদের এই পৈতৃক পেশা ও বিদ্যাকে বুকের ভেতর আগলে রেখেছিলেন।

ভৌগোলিক রহস্য: কেন শুধু সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ?

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, জামদানি কেন কেবল ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ বা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকাতেই ভালো হয়? পৃথিবীর অন্য কোথাও কেন এই মানের জামদানি বোনা সম্ভব হয় না?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে প্রকৃতিতে। জামদানি বোনার জন্য প্রয়োজন বিশেষ একধরণের আর্দ্রতা। শীতলক্ষ্যা নদীর বাষ্প ও বাতাস সুতোর নমনীয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। খুব বেশি শুষ্ক আবহাওয়ায় জামদানির সূক্ষ্ম সুতো ছিঁড়ে যায়। ভোরে যখন কুয়াশা ও নদীর আর্দ্র বাতাস তাঁতশালায় ঢোকে, তখনই মসলিন বা জামদানির সুতো সবচেয়ে ভালো কাজ করে। তাই বংশ পরম্পরায় হাজার হাজার তাঁতি এই নদীর পাড়েই গড়ে তুলেছেন তাদের বসতি। এই মাটি ও জলবায়ুর সাথে জামদানির সম্পর্ক মায়ের সাথে সন্তানের মতো—অচ্ছেদ্য।

বয়নশৈলী: তাঁতির আঙুলে গণিতের খেলা

জামদানি বোনা কোনো সাধারণ কাজ নয়, এটি একটি সাধনা। একে বলা হয় ‘Discontinuous Weft Technique’। সাধারণ তাঁতে মাকু (Shuttle) এপার থেকে ওপারে গিয়ে কাপড় বোনে। কিন্তু জামদানিতে কাপড়ের জমিন বোনার পাশাপাশি আলাদা সুতো দিয়ে নকশা তুলতে হয়।

তাঁতিরা সাধারণত দুইজন মিলে একটি তাঁতে কাজ করেন। একজন মূল কারিগর বা ‘ওস্তাদ’, অন্যজন সহকারী বা ‘সাগরেদ’। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জামদানির এই জটিল নকশাগুলোর কোনো লিখিত বা আঁকা রূপ থাকে না। সবটাই থাকে ওস্তাদের মস্তিষ্কে। তিনি মুখস্থ বলে যান—কোথায় কয়টা সুতো ছাড়তে হবে, আর সাগরেদ সেই অনুযায়ী মাকু চালায়। একে বলা হয় ‘বুলি’। তাঁতিরা যখন কাজ করেন, মনে হয় তারা যেন সুতোর সাথে কথা বলছেন।

একটি ভালো মানের জামদানি বুনতে সময় লাগে এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে ছয় মাস পর্যন্ত। সুতোর মান (কাউণ্ট) যত বেশি হবে, কাপড় তত মিহি হবে এবং সময়ও তত বেশি লাগবে। ৮০ থেকে ১০০ কাউন্টের সুতো দিয়ে সাধারণত এখনকার ভালো জামদানি বোনা হয়। মসলিনের যুগে এই কাউন্ট ৩০০-এর উপরে ছিল বলে ধারণা করা হয়।

নকশার জাদুনগরী: হাজার রকমের নাম

জামদানির আসল সৌন্দর্য তার নকশায়। এই নকশাগুলো জ্যামিতিক এবং প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। নকশার নামগুলোও বেশ কাব্যিক। যেমন:

১. পান্না হাজার: এটি অত্যন্ত ঘন এবং জটিল নকশা। মনে হয় যেন হাজার হাজার পান্না ছড়িয়ে আছে শাড়িজুড়ে।
২. বুটিদার: ছোট ছোট ফুলের নকশা যখন পুরো শাড়িতে ছিটানো থাকে।
৩. তেছরি: যখন নকশাগুলো কোনাকুনি ভাবে উঠে যায়।
৪. জলপাড়: শাড়ির পাড়ে যখন লতানো নকশা থাকে।
৫. কাটিহার: জ্যামিতিক ত্রিভুজ বা চারকোনা নকশা।

এছড়াও শাপলা, জুঁই, করলা, দুবলাঘাস, আদার দানা, সাবুদানা—প্রকৃতির সব উপাদানই বিমূর্ত জ্যামিতিক ফর্মে উঠে আসে জামদানির জমিনে। এই মোটিফগুলোই জামদানিকে অন্য যেকোনো বয়নশিল্প থেকে আলাদা করেছে।

তাঁতিদের জীবনচিত্র: আলোর নিচের অন্ধকার

আমরা যখন হাজার হাজার টাকা দিয়ে একটি জামদানি কিনি, তখন কি একবারও ভাবি সেই কারিগরের কথা? জামদানি তাঁতিদের জীবন খুব একটা সুখের নয়। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও অনেক সময় তারা ন্যায্য মূল্য পান না। মহাজন বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে আসল শিল্পীরা অনেক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

তাছাড়া, নতুন প্রজন্ম এই পেশায় আসতে চাইছে না। কারণ, যে পরিমাণ পরিশ্রম আর মেধা এতে দিতে হয়, তার তুলনায় পারিশ্রমিক অপ্রতুল। তবুও, কিছু পরিবার কেবল ঐতিহ্যের টানে, পূর্বপুরুষের রক্ত ধমনিতে বইছে বলে এখনো তাঁত আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের আঙুলের ডগায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয় সুতোর ঘষায়, সেটাই বোধহয় এই শিল্পের বেঁচে থাকার রসদ।

আসল বনাম নকল: কী করে চিনবেন খাঁটি জামদানি?

বাজারে এখন মেশিন-মেড বা কৃত্রিম জামদানির সয়লাব। যাকে বলা হয় ‘ইন্ডিয়ান জামদানি’ বা সিন্থেটিক জামদানি। আসল জামদানি চেনার উপায় জানাটা জরুরি:

১. ওজন ও স্পর্শ: আসল জামদানি খুব হালকা হয় এবং হাতে নিলে মোলায়েম অনুভূত হবে। সিন্থেটিক শাড়ি খসখসে হয়।
২. পেছনের সুতো: আসল জামদানির নকশা হাতে ঘোরানো সুতো দিয়ে বোনা হয়, তাই উল্টো পিঠে কোনো সুতো কাটা থাকে না, নকশাটি সামনের মতোই মসৃণ হয়। মেশিনে বোনা শাড়ির উল্টো পিঠে সুতো কাটা থাকে।
৩. দাম ও সময়: খুব কম দামে আসল জামদানি পাওয়া অসম্ভব। কারণ এর পেছনে মানুষের শ্রম জড়িত।
৪. ফিনিশিং: আসল জামদানিতে মাড় দেওয়ার পর এক বিশেষ জেল্লা আসে যা কৃত্রিম শাড়িতে থাকে না।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও আমাদের দায়বদ্ধতা

২০১৩ সালে ইউনেস্কো জামদানিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বিশ্বদরবারে এর কদর বেড়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি কেবল একটি সনদপত্র নয়, এটি একটি দায়িত্ব। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের তাঁতিদের বাঁচাতে হবে। তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ‘জামদানি পল্লী’র আধুনিকায়ন এবং বিপণন ব্যবস্থায় তাঁতিদের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন।

উপসংহার: ভবিষ্যতের পথে জামদানি

জামদানি কেবল অতীতের গল্প নয়, এটি বর্তমানের ফ্যাশন এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। আধুনিক ডিজাইনাররা এখন জামদানি মোটিফ ব্যবহার করে কামিজ, কুর্তা, পাঞ্জাবি এমনকি পশ্চিমা পোশাকও তৈরি করছেন। এতে জামদানির ব্যবহারিক ক্ষেত্র বাড়ছে।

তবে মনে রাখতে হবে, জামদানির আসল প্রাণ তার সনাতন বয়নরীতিতে। যন্ত্রের দাপটে যেন হাতের স্পর্শ হারিয়ে না যায়। শীতলক্ষ্যার পাড়ে মাকু চলার খটখট শব্দ যেন কখনো থেমে না যায়। কারণ, যতদিন এই শব্দ থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ তার নিজস্ব সত্তা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। জামদানি আমাদের অহংকার, আমাদের পরিচয়। আসুন, দেশি পণ্য কিনি, তাঁতিদের পাশে দাঁড়াই এবং এই অমূল্য রত্নকে আগলে রাখি পরম মমতায়।


https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *